আঠারোশ সাতান্ন খ্রিস্টাব্দের আগে ব্রিটিশ বিরোধী যে বিদ্রোহগুলি হয়েছিল তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, চুয়াড় বিদ্রোহ, কোল বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ, ফরাজি ও ওয়াহাবি আন্দোলন।
বৃটিশের বিরুদ্ধে প্রাথমিক বিদ্রোহেগুলোর মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য হল সন্ন্যাসী বিদ্রোহ। তারা ছিল শ্রী শঙ্করাচার্যের অনুগামী। শঙ্করাচার্যের অনুগামীরা দশটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিল। বিদ্রোহী সন্ন্যাসীরা ছিল গিরি সম্প্রদায়ভুক্ত। বাংলাদেশে শাসনের প্রথম দিকে ইংরেজ কোম্পানিকে এক প্রবল সন্ন্যাসী বিদ্রোহের সম্মুখীন হতে হয়। ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব থেকে দুটি পৃথক গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়। হিন্দু সন্ন্যাসী ও মুসলিম ফকিররা ক্ষুধার্ত চাষী, সম্পত্তিচ্যুত জমিদার ও কর্মচ্যুত সৈনিকদের অকুণ্ঠ সমর্থন লাভ করে। এই সময় রাষ্ট্রবিপ্লব ও অরাজকতার সুযোগে বিহার, উত্তরপ্রদেশ থেকে আগত একদল নাগা সন্ন্যাসী উত্তরবঙ্গের নানা স্থানে লুটতরাজ ও হত্যাকাণ্ড করে বেড়াতো। তাদের কোনো নির্দিষ্ট বাসস্থান ছিলনা। তারা সাধুর বেশে নানা অঞ্চলে ঘুরেবেড়িয়ে নাবালক শিশু চুরি করে দল বৃদ্ধি করতো। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ব্যবসা-বাণিজ্য করত। বাংলায় ছিয়াত্তরের মন্বন্তর এর পর এদের উপদ্রব ক্রমেই বৃদ্ধি পায়। দরিদ্র কৃষক, সম্পত্তিচ্যুত জমিদার ও বেকার সৈন্যদল এদের সঙ্গে যোগ দেয়। সন্ন্যাসীরা বিভিন্ন অঞ্চলে উপস্থিত হয়ে গৃহস্থর নিকট অর্থ দাবি করত এবং তা না পেলে লুটপাট করত। তাদের উপদ্রবে মালদহ, দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, ঢাকা প্রভৃতি জেলার অধিবাসীরা সর্বদাই সন্ত্রস্ত থাকতো। 1772 খ্রিস্টাব্দে সন্ন্যাসীরা রংপুরে সিপাহীদের যুদ্ধে পরাস্ত করে এবং তাদের নায়ক ক্যাপ্টেন টমাসকে হত্যা করে। সরকারি সেনাদের পরাস্ত করলে তাদের মধ্যে দারুণ উৎসাহের সঞ্চার হয় এবং তারা নানা স্থানে আক্রমণ শুরু করে। একেকজন দলপতির অধীনে প্রায় 5-7 হাজার নাগা সন্ন্যাসী ও অন্যান্যরা থাকতো। পরে তারা বাংলা ও বিহার ত্যাগ করে মহারাষ্ট্রের দিকে চলে যায়। প্রায় 50 বছর ধরে অশান্তময় জীবন নির্ভর করে উনবিংশ শতকের মধ্যভাগে এই বিদ্রোহের অবসান ঘটে। বঙ্কিমচন্দ্রের দেবী চৌধুরানী নামক গ্রন্থে সন্ন্যাসী বিদ্রোহের বিবরণ পাওয়া যায়। বাংলায় সন্ন্যাসী বিদ্রোহের বিখ্যাত নায়ক - নায়িকা ছিলেন ভবানী পাঠক ও দেবী চৌধুরানী। মূলত ইংরেজের শোষণ থেকে রক্ষার জন্য সন্ন্যাসী ও ফকিরদের আবির্ভাব ঘটে। তাদের অসফলতার প্রধান কারণ ছিল অভিজ্ঞতা, যোগাযোগ ও নেতৃত্বের অভাব। সেইসঙ্গে ধর্মীয় ভেদাভেদ তাদের অসফলতার প্রধান কারণ, তাসত্ত্বেও সন্ন্যাসী বিদ্রোহের গুরুত্ব অস্বীকার করা যায়না।
বাংলার মেদিনীপুর জেলায় চুয়াড়দের বসবাস ছিল। 1760 খ্রিস্টাব্দে মেদিনীপুর ইংরেজদের হাতে চলে যায় কিন্তু এই অঞ্চলের জমিদার ছিল অবাধ্য। ধলভূম এর জমিদার জগন্নাথ ধল চুয়াড়দের সংগঠিত করে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। ধৌলক, বরাভূম কোয়লাপাল প্রভৃতি মহলের জমিদাররা এই বিদ্রোহে যোগ দেন এবং রাজস্ব বন্ধ করে দেন। তারা জগন্নাথ ধল ও অন্যান্য স্থানীয় জমিদারের সঙ্গে মিলিত হয় এবং এক ব্যাপক দাঙ্গা-হাঙ্গামার সূত্রপাত হয়। তাদের বিরুদ্ধে ক্যাপটেন মর্গান একদল সৈন্য নিয়ে অগ্রসর হন কিন্তু মর্গ্যান সম্পূর্ণভাবে পরাস্ত হন এবং বহু সেনা নিহত হয়। 1779 খ্রিস্টাব্দে পুনরায় চুয়াড় বিদ্রোহ হয় এবং ব্যাপক নাশকতায় লিপ্ত হয়। মেদিনীপুর এলাকায় তাদের উপদ্রব চরম আকার ধারণ করে। আঠারোশো খ্রিস্টাব্দে বহু অঞ্চলে সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করে। তাদের দমন করতে লর্ড ওয়েলেসলিকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। এই সময় তাদের নেতা ছিল মাধব সিংহ। বিদ্রোহের ব্যাপকতায় মেদিনীপুর শহরের নিরাপত্তা বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। 1832 খ্রিস্টাব্দে রাজা গঙ্গানারায়ন এর নেতৃত্বে চুয়াড় বিদ্রোহ হয়। এই বিদ্রোহ দমনের জন্য সামরিক বাহিনীর সাহায্য নেওয়া হয় তথাপি শান্তি শৃঙ্খলা অনেক দিন ফিরে আসেনি।
১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে জঙ্গলমহলের চাষি প্রজারা যে বিদ্রোহ করেন ইংরেজদের ভাষায় তা ‘চুয়াড় বিদ্রোহ’। চুয়াড় শব্দের অর্থ হল গোঁয়ার, অসভ্য ইত্যাদি। এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন কর্ণগড়ের রানি শিরোমণি। বালিজুড়ি, তসরআড়ার জঙ্গলে তির-ধনুকের বিরুদ্ধে সাহেবদের মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রের লড়াই চলে প্রায় এক বছর। অবশেষে ১৭৯৯ সালের এপ্রিল মাসে রানির অনুচরদের বিশ্বাসঘাতকতায় সমগ্র চুয়াড় বিদ্রোহে ধস নামে। রানি আত্মাহুতি দিয়ে নিজের সম্ভ্রম বাঁচান আর চুয়াড়রা টুকরো হয়ে যায় ইংরেজদের গোলাবারুদের সামনে।
চুয়াড় বিদ্রোহের আরেকজন নেতা ছিলেন বাঁকুড়ার রাইপুর এর জমিদার দুর্জন সিং । তিনি ইংরেজ কোম্পানিকে খাজনা বয়কট করেন এবং নিজেকে রাইপুরের স্বাধীন তালুকদার বলে ঘোষণা করেন । দুর্জন সিং বন্দি হন এবং তার জমিদারি নিলামের ব্যবস্থা করা হয় । কিছুদিন বাদে তিনি ছাড়া পান এবং নিজেকে তিরিশটি তালুকের অধিপতি বলে ঘোষণা করেন ।
1817 খ্রিস্টাব্দে উড়িষ্যায় পাইক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। পাইকরা ছিল আধা সামরিক এবং তাদের সর্দার এর একান্ত অনুগত। তারা ছিল অত্যন্ত দুর্ধর্ষ। চড়া হারে রাজস্বের কারণে উড়িষ্যার বহু জমিদারি বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়। ফলে তাদের অধীনস্থ পাইকরা তাদের জীবিকা থেকে বঞ্চিত হয়। ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে পাইকদের ক্ষোভের সঞ্চার হয়। পাইকরা খুরদার কর্মচ্যুত সেনাপতি বিদ্যাধর মহাপাত্রের নেতৃত্বে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। তারা পুলিশ ঘাঁটি এবং সরকারি কার্যালয়গুলির উপর আক্রমণ করে এবং প্রায় একশো ইংরেজকে হত্যা করে। খুরদা শহরে সরকারি বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। সরকারি কর্মচারীরা পালিয়ে গিয়ে প্রাণ রক্ষা করে। কিছুদিনের জন্য উড়িষ্যায় ইংরেজ শাসন নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
ভারতের অন্যান্য জনসাধারণের ন্যায় প্রাচীন আদিবাসীরাও ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। 1832 খ্রিস্টাব্দের কোল বিদ্রোহ এটাই প্রমাণ করে তারা তাদের স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্য ক্ষুন্ন করতে দিতে মোটেই প্রস্তুত নয়। সিংভূম এর আদিবাসী রাজা তাহার রাজ্যে ইংরেজের প্রবেশ পুরোপুরি নিষিদ্ধ করেন। অবশ্য শেষ পর্যন্ত তিনি ইংরেজদের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। কোল বিদ্রোহের পর মানভূমের ভূমিজীবীরা বিদ্রোহী হয়ে সরকারি কাছারি ও পুলিশ ঘাঁটি জ্বালিয়ে দেয়। এই বিদ্রোহ এমন আকার ধারণ করে যে শেষ পর্যন্ত এক বিরাট সেনাবাহিনীর সাহায্যে দমন করতে হয়। 1831 খ্রিস্টাব্দে ছোটোনাগপুরএ যে কোল বিদ্রোহ হয়েছিল সেই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বুদ্ধ ভগত, জোয়া ভগৎ, ছিন্দরাই মানকি, সুই মুন্ডা। বিদ্রোহের কারণ ছিল বহিরাগত মহাজনদের আগমন, উচ্চহারে রাজস্ব আদায়, ব্রিটিশ বিচার ও রাজস্ব সংক্রান্ত আইন-কানুন প্রবর্তন, কোলদের প্রাচীন সমাজ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করে দেওয়া, রাজস্ব আদায়ের জন্য সীমাহীন অত্যাচার করা প্রভৃতি। 1831 খ্রিস্টাব্দে মুন্ডা, ওরাও সম্প্রদায় সর্বপ্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। এই সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে সিংভূম, মানভূম, হাজারীবাগ উপজেলার সর্বত্র বিদ্রোহ দেখা যায়। চার্লস মেটকাপ এর মতে বিদ্রোহীদের উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজ শাসন ধ্বংস করা তাই বিদ্রোহীদের হাতে জমিদার, যোদ্ধা মহাজন, ইংরেজ কর্মচারী কেউই রেহাই পায়নি। বিদ্রোহ দমনের জন্য দানাপুর, পাটনা থেকে সেনাবাহিনী আসে। হাজার হাজার আদিবাসী নরনারী ও শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করে 1833 খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার এই বিদ্রোহ দমন করে।
এখান থেকে যে প্রশ্নগুলি করতে হবে - সন্ন্যাসী বিদ্রোহ বলতে কী বোঝো, সন্ন্যাসী বিদ্রোহ কবে হয়েছিল, সন্ন্যাসী বিদ্রোহের নেতা কারা ছিলেন, সন্ন্যাসী বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়েছিল কেন, চুয়াড় বিদ্রোহ বলতে কী বোঝো, চুয়াড় বিদ্রোহের নেতা কে ছিলেন, পাইক বিদ্রোহ কবে কোথায় হয়েছিল, পাইক বিদ্রোহের নেতা কে ছিলেন, কোল বিদ্রোহের নেতা কারা ছিলেন, কোল বিদ্রোহ কেন হয়েছিল, কোল বিদ্রোহ কোথায় হয়েছিল প্রভৃতি।
কোন প্রশ্ন থাকলে বা জিজ্ঞাসা থাকলে এই হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে লিখে পাঠাতে হবে 85 97 51 02 99 ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন